alo
ঢাকা, শনিবার, মার্চ ২৫, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১১ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী শহর ও একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ০১:০২ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী শহর ও একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা
alo

 


নীলুফা বেগম: মা: আয় তো বাবা, আমার পাশে চুপটি করে একটু বস তো!

ছেলে: কি যে বলো মা, এখন কি আমার বসে বসে তোমার আদর খাওয়ার সময় আছে। আমার দেশ অনেক বিপদে আছে মা।

মা: এখনই তো এলি আবার এখনি চলে যাবি?

ছেলে: দেশকে শত্রু মুক্ত করে তোমার কাছে ফিরে আসবো মা। তখন তোমার অনেক আদর খাবো।
এই বলে ছেলে খুব দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। 

না! আমি কোন গল্পের প্লটের কথোপকথন এখানে তুলে ধরছি না। এটা নিছক ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও তার মায়ের কাল্পনিক কথোপকথন মাত্র। হয়তোবা ৭১ সালে রাজবাড়ীতে সংগঠিত মুক্তি যুদ্ধে শহীদ রুহুল ইসলাম সাদী ও তার মায়ের শেষ কথোপকথনে এই ধরনের সংলাপই উচ্চারিত হয়েছিলো।

১৫ই ডিসেম্বর ছিলো আমাদের কশবামাজাইল আত্হার হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী  রুহুল ইসলাম সাদীর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর রাজবাড়ী শহরে বিহারীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধে সাদীসহ রকিক ও শফিক শহীদ হন। শত্রু পক্ষের গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে পরে থাকা অবস্থায় বিহারীরা প্রথমে বেয়নেট দিয়ে তাদের দেহগুলোকে ক্ষত বিক্ষত করে। তারপর দেহ থেকে মাথাগুলো আলাদা করে নিয়ে যায়। পরের দিন ১৬ ই ডিসেম্বর মস্তকহীন মৃত দেহগুলো পাওয়া যায় এবং সেগুলোকে রাজবাড়ী লক্ষীকোল মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। 

১৯৭১ সালে রুহুল ইসলাম সাদী বিমান বাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে কার্যরত ছিলেন। পাক বাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারত হয়ে দেশে চলে আসেন। দেশে এসে এলাকার লোকজনদের মুক্তি বাহিনীতে যোগদানে জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই কশবামাজাইলের নাদীর হোসেন গার্লস স্কুলে ও বনগ্রাম গ্রামে স্থানীয় যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিন মিঞার সাথে যোগ দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। 

শহীদ রুহুল ইসলাম সাদীর সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি অথবা রাজবাড়ীতে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় সেটাও আমি দেখিনি কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়েছিলো। 

যুদ্ধকালীন সময়ে আমার মেজো ভাইয়ের পোস্টিং ছিলো মাদারীপুর জেলায়। যুদ্ধের প্রথমদিকে ভাইয়ের পরিবার আমাদের গ্রামের বাড়িতেই ছিলো। মিলিটারি চেকপোস্ট পেড়িয়ে বারবার আসা যাওয়া করাটা বিপদজনক ভেবে মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ভাই ছেলেমেয়েদেরসহ ভাবীকে মাদারীপুর নিয়ে যায়। আমি ও আমার ছোট ভাই ওদের সাথে যাই। সেখানে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে থাকতে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই রাজবাড়ী মুক্ত হওয়ার দুইদিন পরই আমরা দুই ভাইবোন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। রাজবাড়ীতে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত্রি যাপন করি। সেখানেই শুনেছিলাম রাজবাড়ীতে সংগঠিত যুদ্ধের নৃশংসতার কথা। খুব ভোরের ট্রেন ধরতে হবে তাই ফজরের নামাজের পর পরই একটা রিকশা নিয়ে ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। নিস্তব্ধ রাস্তায় প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাওয়ালাই বিহারী আর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের ভয়াবহতার কথা বর্ণনা করতে করতে রিকশা চালাচ্ছিলো। রাস্তায় তখনো রক্তের জমাটবাধা দাগ লেগেছিলো। এ দৃশ্য কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। কান পাতলেই যেন শুনা যাচ্ছিলো নিরীহ, নিরপরাধ মৃত মানুষেদের আত্মার কান্নার ধ্বনি। এখনো মনে হলে শরীর শিরশির করে উঠে। বাড়িতে আসার পর জানতে পারলাম রুহুল ইসলাম সাদীর নৃশংস হত্যার কথা। 

রাজবাড়ী রেলের শহরের কারণে ছিল বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। প্রায় ২০ হাজার পাকিস্তানি অবাঙ্গালী বিহারীদের বসবাস ছিল শহরের নিউ কলোনি, আঠাশ কলোনি, স্টেশন কলোনি ও লোকোশেড কলোনি এলাকায়। পাকিস্তান আমলে পুরো রেলটাই ছিলো তাদের দখলে। এই কারণে রাজবাড়ীতে ছিলো বিহারীদের দুর্দান্ত প্রভাব। 

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল রাত ৩টার দিকে আরিচা থেকে বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর চিমারের নেতৃত্বে একদল সৈন্য গোয়ালন্দ ঘাট অতিক্রম করে নারার টেগ ও মমিন খাঁ এর ঘাট দিয়ে রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করে। পাকবাহিনী রাজবাড়ীতে প্রবেশের পর পাকিস্তানি বিহারীরা ও বাঙালী রাজাকারের দল তাদের সাথে মিলে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এই অঞ্চলের নিরীহ মানুষদের। হত্যা করার পর লোকশেড কলোনির কুপে ফেলে দিতো সেইসাথে দোকানপাট সহ আশেপাশের মানুষের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। 

পাকিস্তানি বিহারীদের এই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এবং রাজবাড়ীকে শ্ত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুর, যশোর, মাগুরা ও কুষ্টিয়া থেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। এ খবরে বিহারীরা রাজবাড়ী রেল লাইনের পাশে অবস্থান নেয় এবং লোকোশেড থেকে ড্রাই-আইস ফ্যাক্টরি পর্যন্ত মালগাড়ী দিয়ে রেল লাইন অবরুদ্ধ করে রাখে।

মুক্তিযোদ্ধারা বিহারীদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করতে থাকলেও মালগাড়ীর কারণে বিহারীদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। পরে বিকল্প পন্থা হিসেবে যশোর থেকে আনা মর্টারের গুলি বর্ষণ শুরু করলে বিহারীদের সাথে তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই যুদ্ধে কয়েক হাজার বিহারী নিহত হয়। এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। 

মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার প্রতিরোধের মুখে নিশ্চিত পরাজয় ভেবে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১ টার সময় রেল লাইন ধরে কয়েক হাজার বিহারী আত্মসমর্পণ করে। যাদের বেশির ভাগই ছিলো মহিলা কেননা অধিকাংশ পুরুষ বিহারি যুদ্ধ করার সময় মারা যায়। ঐদিনই রাজবাড়ীকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এই যুদ্ধে রুহুল ইসলাম সাদী, খুশি, রফিক, শফিকসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং আহত হয় অনেকে। 

রাজবাড়ী তথা সারা দেশজুড়ে যে সমস্ত শহিদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, লাল সবুজের একটি পতাকা পেয়েছি এই বিজয়ের মাসে তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি রইলো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। 

লেখক: ক্যালগেরি, কানাডা প্রবাসী।

X