চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম সিটি করপোরশনের (চসিক) ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে যিনি ২০০৭ সালে সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন ইস্পাহানি মিলস লিমিটেড নামে একটি কারখানায়। ২০১৪ সালে শুরু করেন পাহাড় গিলতে শুরু করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেই ১৫ বছরে কামিয়েছেন অন্তত শতকোটি টাকা। নগরের বিভিন্ন থানায় ১০টির বেশি চাঁদাবাজি, মারামারি, দখলবাজি, পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলাও আছে ‘পাহাড়খেকো’ এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরের আকবর শাহ এলাকার লেকসিটি আবাসিকের পাশেই উত্তর পাহাড়তলী মৌজার পাহাড়। সেখানকার পাহাড় কেটে সমতল বানানো হয়েছে। সীমানাদেয়াল দিয়ে বানানো হয়েছে কয়েকটি প্লট। অনেক প্লটে আবার নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি। লেকসিটি আবাসিকের গেইটের সামনে পাহাড়ায় সার্বক্ষণিক পাহাড়ায় থাকে একদল যুবক। যারা কাউন্সিলর জসিমের ‘গুন্ডাবাহিনী’ হিসেবেই পরিচিত। সেখানে ঢুকতে গেলেই তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয় সবাইকে। তারাই মূলত পাহাড় কাটার কাজ করে থাকে কাউন্সিলর জসিমের হয়েই।
সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ওই দিন দুপুরে নগরীর আকবর শাহ থানার সুপারি বাগান এলাকায় পাহাড় কেটে খাল ভরাটের স্থান পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হন রিজওয়ানা হাসান ও তার টিমের সদস্যরা। এ ঘটনায় আকবর শাহ থানায় করা মামলায় জসিম ও তার সহযোগীদের আসামি করা হয়।
বেলাপ্রধানের দায়ের করা মামলায় কাউন্সিলর জসিম ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মো. হৃদয়, আবু নোমান ওরফে কালা নোমান, সাইফুদ্দিন ভূঁইয়া, আনিস চৌধুরী রাজন, শাকিল ও সাঈদ।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধের বিষয়ে আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। কাউন্সিলরই মূলত এর হোতা। আমরা বিষয়টি আবার আদালতের নজরে এনেছি। কাউন্সিলর একটি বাহিনী গড়ে তুলে সেখানে পাহাড় ও ছড়া ধ্বংস করে ফেলেছেন।’
গত বছর ২৮ ডিসেম্বর কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মী মো. শফিকুল ইসলাম।
এতে তিনি অভিযোগ করেন—২০১৪ সাল থেকে কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম পাহাড় কাটা শুরু করেন। তার নিয়ন্ত্রণে ১২ জনের একটি গ্রুপ আছে। সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় কেটে ৩ ও ৫ কাঠা করে প্রতিকাঠা ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করেন জসিম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের আকবর শাহ এলাকার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার খতিয়ানে ১৭৮ নম্বর দাগে তিনটি পাহাড়ের কথা উল্লেখ আছে। সেখানে ১২ শতক জমির মালিক ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিম এবং তাঁর স্ত্রী তাছলিমা বেগম। আর এই সুযোগই কাজে লাগিয়েই ইচ্ছেমতো পাহাড় কাটছেন কাউন্সিলর জসিম। বেলতলীঘোনা নামের আরেকটি এলাকায় রয়েছে তিন একরের একটি পাহাড়। সেই পাহাড় কেটে জহুরুল তার বাবা আবিউল হকের নামে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছেন। সেখানে ৫০ শতাংশ পাহাড় কাটা শেষ। এর আধা কিলোমিটার দূরত্বে সরকারি পাহাড় কেটে (১৭৭ দাগ) ও কালিরছড়া ভরাট করে গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত কার্যালয় ও আরেকটি গরুর খামার। এ তিন এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগে জহুরুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় তিনটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন কাউন্সিলর জসিম। বর্তমানে তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকেই জসিমের বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যুক্ত থাকার অভিযোগ পুলিশের কাছে আসতে থাকে। তার বিরুদ্ধে পাহাড়তলী ও আকবশাহ এলাকায় পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি, কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের দেড়শতাধিক দোকান দখল এবং বিশ্বব্যাংক কলোনি এলাকায় কবরস্থানের জায়গা দখলেরও অভিযোগ আছে।
২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাহাড় কাটার দায়ে কাউন্সিলর জসিমের স্ত্রী তাছলিমা বেগমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদফতর। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ মে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক নানজীন সুলতানা। কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। একই ঘটনায় ২০২২ সালের ১০ আগস্ট কাউন্সিলর জসিম এবং তার স্ত্রী তাছলিমা বেগমসহ তিন জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. সাখাওয়াত হোসাইন নগরীর আকবর শাহ থানায় আরও একটি মামলা করেন।
এসব অভিযোগেরে বিষয়ে কাউন্সিলরের জসিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি ‘ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে’ উল্লেখ করে বলেন, ‘পাহাড় কে কাটছে, কারা কাটছে আমি জানি না। আমার ওয়ার্ডের অর্ধেক লোক থাকে পাহাড়ে। পাহাড় কেটে তারা হয়তো বাড়িঘর করে। এখন সবাই পরিচয় দেয় কাউন্সিলরের লোক। পাহাড় কাটার সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
বেলার প্রধান নির্বাহীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত না থাকার সাফাই গেয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহীর ওপর হামলায় ঘটনায় আমি জড়িত নই। আমার নেতৃত্বে হামলা হয়েছে, এমন কোনও ছবি কেউ দেখাতে পারবে না। যারা হামলা করেছে, তাদের বিচার চাই। অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ করেছেন। এজন্য মামলা হয়েছে।’
লেকসিটি এলাকায় অব্যাহত পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এতে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে বিবাদী করা হয়। রিটে আকবর শাহ থানা এলাকার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার সাড়ে ১০ একর পাহাড় কাটা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। পরে ২০২০ সালে ওই এলাকার পাহাড় রক্ষার বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছিলেন।
পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, ‘পাহাড় কাটার ঘটনায় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধে দুটি মামলা চলমান। তার স্ত্রীকেও পাহাড় কাটার ঘটনায় জরিমানা করা হয়েছিল। নতুন করে আবারও পাহাড় কাটছেন তিনি—এই বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। সম্প্রতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ওপর হামলার পর পাহাড় কাটার বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নিউজনাউ/আরএইচআর/পিপিএন/২০২৩