পার্থ প্রতীম নন্দী, চট্টগ্রাম ব্যুরো: তথ্য মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে কলকাতা ও আসাম থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ৩৪ জন সাংবাদিকের একটি বহর। গত ৬ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন তাঁরা। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দরা।
সফর চলাকালীন সময়ে কলকাতা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কিংসুক প্রামাণিকের সাথে কথা হয় নিউজনাউ টোয়ান্টিফোরের। এসময় দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি এই ভ্রমণে তাঁর ভালো লাগার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, তাঁর মা বাংলাদেশি। রাজশাহীতে জন্ম। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে মাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প শুনাবেন। তিনি বলেন, আমাদেরই পরিবার বাংলাদেশ। আমি আমার মা’কে নিয়ে একবার বাংলাদেশে আসব। রাজশাহীতে যাব মায়ের বাড়িতে দেখাতে এবং এখান থেকে ফিরে গিয়েই গর্ব করে বলবো তোমার দেশ বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।
এর আগে তিনি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করেন। তাঁর সেই বক্তব্য উপস্থিত প্রায় সকলকে ভীষণ আবেগ তাড়িত করে।
তিনি বলেন, আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। একইসঙ্গে দুটো জিনিস আমার মনে হচ্ছে। আমার মা তো রাজশাহীর মেয়ে ছিলেন। যখন আমি বড় হই তখন মা আমাকে বলেছিলেন যে, যদি বাংলাকে চিনতে চাস তাহলে পদ্মার পাড়ে যাস। মানে বাংলাদেশে যাস। কিন্তু বাংলাদেশে কি করে যাব? বাংলাদেশ তো আমার নিজের দেশ নয়।'
'তার মাঝে তো একটা কাঁটাতারের বেড়া সৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার পেশার সূত্রে অবশেষে বাংলাদেশে আসার সুযোগ হয়ে গেল। আমি এর আগে অনেকবার বাংলাদেশে এসেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আজকের মতো আমি আনন্দ অথবা বলতে পারেন আমার ভেতরে একটা ক্রোধ…আমি ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছি একটা শব্দ দেখে। সেই শব্দটা হচ্ছে, dog and indian prohibited.'
'সেটা কোথায় লেখা ছিল? ওই ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে। যে বোর্ডটা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে৷ যদি আজ ওই বোর্ডটা থাকতো আমি নিজের হাতে ভেঙ্গে দিতাম। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের কি ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণার চোখে দেখতো শুধু ওই একটা কথাতে বোঝা যায়। যে স্বাধীনতা সংগ্রাম আমরা তো খুব আনন্দ করছি৷ আপনারা তো দু’বার স্বাধীনতার লড়াই করেছন। একবার ৪৭ এ স্বাধীনতা পেয়েছেন, একবার ১৯৭১ এ স্বাধীনতা পেয়েছেন। একবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে, একবার পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।'
'কিন্তু আমি বলছি যে স্বাধীনতা সংগ্রাম কি ভয়ঙ্কর জিনিস, কি ভয়ঙ্কর একটা আত্মত্যাগ আত্মবলিদান দিতে হয়৷ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যেভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন সেই ইতিহাসটা আপনারা রেখে দিয়েছেন। আমার ভাল লেগেছে যে এই অতীত, এই অতীতকে আপনারা সংরক্ষিত করেছেন। এর বাইরেও অনেক আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক সংগ্রাম। চট্টগ্রামের কথা আপনারা জানেন না। আমাদের চিন্তা, মননে, চেতনে, বাঙালির হৃদয়ের মধ্যে সূর্যসেনের নাম লেখা রয়েছে। আমরা সবসময়ই সূর্যসেনকে নিয়ে আলোচনা করি। যখনই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে…যখন ১৫ই আগস্টের কোনো না কোনো মিছিল, কোনো না কোনো সভায় কেউ বক্তৃতা দেয়; তার সামনে যখন আমরা নেতাজির কথা বলি। তাহলে কিন্তু প্রীতিলতার কথা বলি, আমরা সূর্য সেনের কথা বলি। তো সেই মাটিতে আজকে আমাদের আসার সুযোগ করে দিয়ে, আমি সত্যি করে বলছি আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। একইসঙ্গে, আমি বিস্মিত। আমি বিস্মিত এই কারণে যে আমি ১০ বছর আগেও বাংলাদেশে এসেছিলাম। আজকে এসে আমার অবাক লাগছে। আমি ঢাকা শহরে দেখছি একের পর এক উড়াল সেতু, একের পর এক মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে। একসময় ঢাকায় এসে যানজটে এতটাই বিরক্ত হয়ে পড়তাম। মনে হতো যে, কেন যাব। আজকে ঢাকা শহর এই যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, যেভাবে উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়ছে সেটা দেখে আমার মনে হচ্ছে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও উন্নয়নে সমানতালে এগিয়ে চলছে এবং এখানে এসে কার্যত সমুদ্রই বলব। যে কর্ণফুলীর ওপর আপনারা টানেল তৈরি করেছেন সেটা অভাবনীয়। আমাদের ওখানে যে গঙ্গার নিচে টানেল তৈরি হচ্ছে সেটা হবে ১০০-২০০ মিটার। কিন্তু আপনারা এতবড় একটা টানেল তৈরি করে ফেললেন কর্ণফুলী নদীর ভেতর দিয়ে সেটা এক কথায় অভাবনীয়। কলকাতা শহরে আপনারা যে যে ইংরেজি সংবাদপত্র অথবা চ্যানেল দেখেন তার সমস্ত কাগজের একজন করে প্রতিনিধি, সিনিয়র জার্নালিস্ট যারা তারা কিন্তু পর্যবেক্ষণ করলেন।'
তিনি বলেন, আপনাদের বলে যাচ্ছি, ২৪টা চোখ কিন্তু গত ৭২ ঘন্টা ধরে আপনাদের দেশকে দেখছে। যে অভিজ্ঞতা আজকে দিনটা এবং কালকের দিনটা হয়তো আমরা থাকব। এরপর ফিরে যাওয়া আছে। যে অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করে গেলাম, সেটা অবশ্যই আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরবো। আমাদের লেখায় তুলে ধরবো, আমাদের বলায় তুলে ধরবো, আমাদের আচরণে তুলে ধরবো।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। বাংলাদেশ এগোলে আমরা সত্যিই আনন্দ পাবো। বাংলাদেশ যদি এগিয়ে যায় আমাদেরই তো লাভ। আমাদেরই ভাই-বোন এগোচ্ছে।'
নিউজনাউ/আরএইচআর/২০২৩